
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। রূপে ও স্বাদে মাছের রাজাও বলা চলে। জাতীয় মাছ হিসেবে ইলিশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব বরাবরই অনেক বেশি। ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধির মাধ্যমে এর দাম নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে ইলিশ মাছ খাওয়ার। ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে ইলিশ মাছকে আমাদের দেশের মাছ মনে করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দূষণ ও পানি দূষণের ফলে ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধিসহ নানা রকম জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইলিশের মজুদের বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। ইলিশের ঝাঁক মোহনার দিক পরিবর্তন করে নিম্নাঞ্চলে যেতে পারে, সাধারণ জেলে যারা ইলিশ মাছের সাথে জড়িত তারা সংখ্যায় কম মাছ পাবে।
মাছ জেলেদের হাতের বাইরে চলে যাবে, বঙ্গোপসাগরের সাইক্লোন বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে। ইলিশের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা এই তিনটি নদীর মোহনায় পানি প্রবাহ কমে গেলে। ইলিশের প্রজনন ক্ষমতা কমে আসবে, কলকারখানার বর্জ্য বা কীটনাশকসহ পানি দূষণের ফলে।
প্রকৃতিগত ভাবেই ইলিশ মাছ দ্রুত দেশ্রুপন্তরকারী মাছ। অত্যধিক মাত্রায় পানি দূষণ ও পানিতে বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাওয়ার ফলে ইলিশ দ্রুতই দেশ রূপান্তর করতে পারে। ইলিশ মিঠা পানিতে ডিম পাড়ে এবং পরবর্তীতে নোনা পানিতে চলে যায়। একটি মা ইলিশের ডিম ধারণ করার ক্ষমতা ১৫ থেকে ২০ লাখ।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি দূষণের কারণে ইলিশের প্রজনন ক্ষমতা দিন দিন কমে বর্তমানে ১২ লাখ এসে দাঁড়িয়েছে। ইলিশ মাছ সাগরে থাকলেই ধরা পড়ে না। অনেক সময় ইলিশ মাছ গভীর পানি থেকে উঠে আসে না। এর জন্য প্রয়োজন অনুকূল আবহাওয়া। যেমন পর্যাপ্ত বৃষ্টি, পানির চাপ, খাদ্য ইত্যাদি। এই মাছের প্রথম দাবিদার হচ্ছেন অতিদরিদ্র জেলেরা তাদের জন্যই মাছ সংরক্ষণ করা হয়। প্রকৃতির এক আজব নিয়ম, মাছ না ধরলে এটা পাকৃতিকভাবেই শেষ হয়ে যাবে।
এ বছর মৌসুমের অর্ধেক সময় এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেলও আশানুরূপ ইলিশের দেখা নেই, দাম ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। তারপরও যতটুকু মাছ আহরিত হয় তার একটি বড় অংশ চলে যায় উপসাগরীয় দেশগুলোসহ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় এই দেশগুলোই ইলিশের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। অন্যদিকে ভারতে যেটুকুই ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার বড় অংশই আসছে দেশটির পশ্চিম উপকূলের নর্মদা মোহনা সংলগ্ন এলাকা থেকে।
বিদেশের বড় বড় বাজারে অনেক দামে বিক্রি হয় বাংলাদেশের ইলিশ, এটা একটা পরিতাপের বিষয়। অথচ দেশের ক্ষুদ্র জেলেরা এই বিশাল মুনাফার ছিটেফোঁটাও পায় না। নদীতে মাছের সংকটের কারণে কেবলমাত্র জেলেরাই ক্ষতিগ্রস্ত নন, সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই খাতের সাথের যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। এই মৌসুমে মূলত ইলিশ মাছের প্রধান চালান আসে সাগর থেকে।
মোহনায় অতিরিক্ত পলি জমার ফলে নদীমুখগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর এর ফলে প্রজনন মৌসুমে ইলিশের পরিযান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি ইলিশ মাছের উজানে যেতে প্রয়োজন তুলনামূলকভাবে দূষণমুক্ত পানি। ইলিশের চিহ্নিত অভয়াশ্রম বা চলাচলের রাস্তায় নৌপরিহন চলাচলের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে যা ইলিশের পরিযান বা অভিপ্রয়ানকে বাধাগ্রস্থ্য করছে। নদীর উপরে ও নদীতে স্থাপিত নানা ধরনের বাঁধ ও ব্যারাজের বিষয়টি।
ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গণসচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। বাংলার এই রুপালি ইলিশ নিয়ে আরও বিস্তৃত পর্যায়ে গবেষণা প্রয়োজন। পানি দূষণ রোধ, পানিতে যেন বর্জ্য পদার্থ, রাসায়নিক দ্রব্যাদি এছাড়াও কোন ধরনের দূষণ না ঘটে সেদিকে বিশেষ নজরদারি জোরদার করতে হবে।
২০১১ সাল থেকে জাটকা বা মা ইলিশ না ধরার জন্য সরকার সকল জেলেদের সচেতন করে আসছে। দরিদ্র জেলেদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় তাদের অনেক বেশি সহযোগিতা দিতে হবে। ইলিশ সংরক্ষণে একটি স্বতন্ত্র তহবিল গঠন করা প্রয়োজন, যেন দুর্যোগের সময় জেলেদের বেশি করে সহায়তা দেওয়া যায় সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাহায্যে মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণ করতে হবে।
যেসব জেলেদের মাছ ধরার ক্ষমতা নেই তাদেরকে ইলিশ মাছ ধরার সামগ্রী দিয়ে সরকার সাহায্য করতে পারে। ইলিশ মাছ সংরক্ষণে জেলেদের বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য বিতরণ একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। জেলেদের প্রণোদনা, গণমানুষের ব্যাপক সচেতনতা ও প্রশাসনের উদ্যোগ ইলিশ উৎপাদনে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারবে সর্বোপরি ইলিশ মাছ রক্ষায় এবং এর প্রজনন বৃদ্ধিতে প্রতিটি মহলের সর্বাধিক সচেতনতা জরুরি।
Be the first to comment